বাঙ্গালীর স্মৃতি সততই দুর্বল, সাথে তার ইতিহাস চেতনাও। কিন্তু সর্বনাশের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা বাঙ্গালী হিন্দুর পক্ষে আজ এই আত্ম-প্রবঞ্চনা/ছলনা সাজেনা, তাঁকে তাঁর হারিয়ে যাওয়া ইতিহাস, পূর্বপুরুষের বলিষ্ঠ প্রচেষ্টা অথচ যা সামগ্রিক ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছিল তার যথোপযুক্ত বিশ্লেষণ করতে হবে। ফিরে পেতে হবে ইতিহাস যা এক ঘৃণ্য, সুবিশাল, চরম স্বার্থান্বেষী চক্রান্ত র দ্বারা পদদলিত করা হয়েছে, মুছে ফেলার নির্মম প্রচেষ্টা আজও হয়ে চলেছে। নতুবা তাঁদের সংখ্যাই বৃদ্ধি পাবে যাঁরা নিজে বাঙ্গালী হয়েও অন্য জাতির কীর্তির সঙ্গে তুলনা করে নিজ জাতিকে হেয় করার চেষ্টা করে। আমরা ভুলে গেছি অনেকগুলি নাম – শ্রী ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তী (মহারাজ), শ্রী শ্রীশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, শ্রী ভূপেন্দ্র কুমার দত্ত, শ্রী সতীন সেন, শ্রী ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, শ্রী মনোরঞ্জন ধর, শ্রী গোবিন্দলাল বন্দোপাধ্যায় – যাঁরা ১৯৪৭ সালে দেশভাগজনিত কারণে বিভক্ত-পূর্ব পাকিস্তান (বর্তমান বাংলাদেশ) এ হিন্দু স্বাৰ্থ সুরক্ষা করার প্রাণপণ চেষ্টা করেছিলেন। আজ আমরা ভুলে গেছি শ্রী শ্রীশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (অনুশীলন সমিতি র প্রখ্যাত বিপ্লবী, পরবর্তীকালে পাকিস্তানে কংগ্রেস নেতা) র দ্বারা প্রদত্ত বিখ্যাত ও ঐতিহাসিক বক্তব্য পাকিস্তানের Constituent Assembly র প্রথম অধিবেশনে (মার্চ ১২, ১৯৪৯) পূর্ব পাকিস্তানে সংখ্যালঘু হিন্দু জনগণ র সুরক্ষা র জন্য – যা পাকিস্তান পার্লামেন্ট archive করে রেখেছে আজ \ও। আমরা ভুলে গেছি ঢাকায় অনুষ্ঠিত ভাষা আন্দোলন, ১৯৫২ জনিত কারণে গ্রেপ্তার তৎকালীন তিন হিন্দু এমএলএ শ্রী মনোরঞ্জন ধর, শ্রী গোবিন্দলাল বন্দোপাধ্যায়, শ্রী সতীন সেন র কথা। অপর দুজন এমএলএ যাঁরা গ্রেপ্তার হয়েছিলেন তাঁরা হলেন – মৌলানা আব্দুর রশিদ তর্কবাগীশ, জনাব শরফুদ্দিন আহমেদ। বর্তমান বাংলাদেশে এই তিন হিন্দু এমএলএ র কোন ছায়া পর্যন্ত দেখা যায় না। এপার অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গের কথা না বলাই ভালো।
একইভাবে শ্রী ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের নামটিও বিস্মৃত সম্পূর্ণ অৰ্থে। অথচ এই ব্যক্তি না থাকলে, যদি তিনি ১৯৪৮ সালের ২৩শে ফেব্রুয়ারীর সভায় রুখে না দাঁড়াতেন জিন্নার ঔদ্ধত্যপূর্ণ চিন্তা – একমাত্র উর্দু ই হবে পাকিস্তান র ভাষা – র বিরুদ্ধে তাহলে বাংলা ভাষা জনিত এতো আবেগ, ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনের জন্মই হতোনা পৃথিবীতে। বাংলা হিন্দুদের ভাষা – এই প্রচার প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়ে গিয়েছিল ততদিনে নবনির্মিত পূর্ব পাকিস্তানে। কুমিল্লার লাকসাম রোডে “অভয় আশ্রম”, স্বনামধন্য শ্রী মহেশ ভট্টাচার্য দ্বারা প্রতিষ্ঠিতর পাশে ঈশ্বর পাঠশালা ও রামলাল ছাত্রাবাস গড়ে ওঠে। ধীরেনবাবু এইসব প্রতিষ্ঠানের সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত ছিলেন। ১৯৫৪ সালে, হিন্দু স্বার্থ সুরক্ষিত করার জন্য, তিনি ইউনাইটেড প্রগ্রেসিভ পার্লামেন্টারী পার্টি গঠন করেন। ধীরেনবাবু সভাপতি, অধ্যাপক পুলিন দে সম্পাদক নিবাচিত হন। অন্যান্য নমস্য সদস্যদের মধ্যে ছিলেন বিপ্লবী নেতা মহারাজ ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তী, শ্রী প্রভাসচন্দ্র লাহিড়ী, শ্রী ফণী মজুমদার, শ্রী রমেশ দত্ত, শ্রী আশুতোষ সিংহ, শ্রী হারান ঘোষ চৌধুরী, শ্রী দেবেন ঘোষ, শ্রী কামিনী কুমার দত্ত সহ বহু ব্যক্তি যাঁদের মধ্যে ১২ জন যুক্তফ্রন্টের টিকিটে জয়ী হন।
যুক্তফ্রন্টের মন্ত্রিসভায় শ্রী ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত স্বাস্থ্য মন্ত্রী, শ্রী মনোরঞ্জন ধর অর্থমন্ত্রী, শ্রী শরৎ মজুমদার মৎস মন্ত্রী, শ্রী গৌরচন্দ্র বালা বনমন্ত্রী হিসেবে যোগদান করেন। কুমিল্লা র রামরাইল গ্রামে ধীরেনবাবুর যা সম্পত্তি ছিল তা তিনি জনকল্যাণের জন্য দান করে গেছেন। শ্রী ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত বঙ্গের আকাশে এক পরাক্রমী, দেদীপ্যমান সূর্য হিসেবে উদিত হয়েছিলেন যার তাপ পাকিস্তান সহ্য করতে পারেনি। তাই, ২৯ মার্চ, ১৯৭১ সালে, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন, পাকিস্তান আর্মি রাতের অন্ধকারে ধীরেনবাবু ও তাঁর পুত্র দিলীপ দত্ত কে আগ্নেয়াস্ত্রের মুখে তুলে নিয়ে যায় কুমিল্লার ময়নামতি সেনানিবাসে।
সেনানিবাসের ক্ষৌরকারের সূত্রে জানা যায়, শ্রী দিলীপ দত্ত কে বেয়নেট দিয়ে কুপিয়ে কুপিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। ৮৪ বছরের বৃদ্ধ ধীরেনবাবুর হাত-পা প্রথমে ভেঙে দেয় নরপশুরা। এরপর জীবন্ত অবস্থায় তাঁর চোখ দুটি উপড়ে ফেলে হিংস্র রক্তখেকোরা। ১৪ই এপ্রিল ভোরবেলায় গুলি করে তাঁকে হত্যা করা হয়। বঙ্গ আকাশে উদিত সূর্য অস্ত যায়। আকাশবাণী থেকে বেতার তরঙ্গে ধীরেনবাবুর মৃত্যুসংবাদ সর্বপ্রথম প্রচারিত হয়। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে ভারতের লোকসভায় এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়।
এরকম অসংখ্য ইতিহাস ছড়িয়ে আছে আমাদের আশেপাশে কিন্তু আমরা দেখিনা, অন্যদের ইতিহাস মুখস্থ করে নিজেদের পন্ডিত মনে করি। প্রসঙ্গত, মুক্তিযুদ্ধ র সময় স্বাধীন বাংলাদেশ র রাজধানী মুজিবনগর ঘোষিত হয় কুষ্টিয়া জেলার বৈদ্যনাথতলা নামক এলাকায়। শতাধিক বিঘার আমবাগানই হল বৈদ্যনাথতলা। উক্ত জমির মালিক শ্রী কেদার নাথ (একজন অসহায় হিন্দু ব্যক্তি) র জমি জবরদখল করে গড়ে উঠেছে মুজিবনগর। ২০০ বছর পূর্বে ওই গ্রামের হিন্দুরা বৈদ্যনাথ ধাম থেকে পবিত্র মাটি নিয়ে ওই আমবাগানে শিবমন্দির গড়ে তুলেছিলেন। এরপর থেকেই উক্ত স্থান র নাম বৈদ্যনাথতলা হিসেবে প্রচারিত হয়। এখন ও সেই শিবমন্দির টি জীর্ণ অবস্থায় কালের সাক্ষী হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে। ওই এলাকার সমস্ত হিন্দু বিতাড়িত হবার ফলে মন্দিরে নিয়মিত পূজাপাঠ বন্ধ হয়ে গেছে।
হঠাৎ এই কথা? এই অসামান্য ইতিহাস সম্পর্কে অবহিত হওয়া, আত্মস্থ করা আজ সর্বনাশ ও স্বীয় অস্তিত্বরক্ষার দ্বারপ্রান্তে দন্ডায়মান বাঙ্গালী হিন্দুর এক আবশ্যিক কর্তব্য।
তথ্যসূত্র কৃতজ্ঞতা সহ: বিভিন্ন ওয়েবসাইট, নিখিল বঙ্গ নাগরিক সঙ্ঘ দ্বারা প্রকাশিত, “ভুলে গেছে বাংলাদেশ, ভুলে গেছে বাঙ্গালী”……….
(Inset picture/সন্নিবিষ্ট ছবি: শ্রী ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, নাতনি শ্রীমতি অরোমা দত্ত, নাতি শ্রী রাহুল দত্তের সাথে)